মেসেঞ্জারে নিরাপদ থাকতে এই ৫টি সেটিংস মিস করবেন না!
![]() |
সঠিক প্রাইভেসি সেটিংস চালু করুন, নিজেকে হ্যাকারদের হাত থেকে বাঁচান! |
আজকের বাংলাদেশে, ফেসবুক মেসেঞ্জার শুধু বন্ধুদের সাথে কথা বলার একটি অ্যাপ নয়, এটি আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পারিবারিক গ্রুপ চ্যাট, অফিসের জরুরি ফাইল শেয়ারিং, অনলাইন ব্যবসার গ্রাহক সেবা থেকে শুরু করে দূরে থাকা প্রিয়জনের সাথে ভিডিও কলে কথা বলা—সবকিছুই এখন মেসেঞ্জারের মাধ্যমে হচ্ছে। আমাদের এতসব ব্যক্তিগত এবং পেশাগত কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায়, এর নিরাপত্তাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি কি জানেন, সামান্য কিছু ভুলের কারণে আপনার মেসেঞ্জার হ্যাকিং-এর শিকার হতে পারে? একবার আপনার অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ হ্যাকারের হাতে চলে গেলে, তারা আপনার ব্যক্তিগত কথোপকথন ফাঁস করে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে, আপনার বন্ধুদের কাছে আপনার নাম করে টাকা চাইতে পারে, অথবা আপনার ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্যের অপব্যবহার করতে পারে।
কিন্তু ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনার মেসেঞ্জার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনো রকেট সায়েন্স নয়। এই আর্টিকেলে আমরা আপনাকে এমন ৫টি জরুরি মেসেঞ্জার সেটিংস সম্পর্কে জানাব, যা চালু করতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় লাগবে না, কিন্তু আপনার ডিজিটাল জীবনকে দেবে দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা। চলুন, আপনার ব্যক্তিগত চ্যাটের জগতকে সুরক্ষিত রাখার এই অভিযানে নেমে পড়া যাক।
সেটিং ১: এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন (End-to-End Encryption) - আপনার চ্যাটের অদৃশ্য তালা
আপনি যখন কাউকে একটি ব্যক্তিগত চিঠি পাঠান, তখন নিশ্চয়ই চান না যে পোস্ট অফিসের কর্মচারী বা অন্য কেউ সেটি খুলে পড়ুক। এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন (E2EE) হলো ঠিক সেই রকম একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন কী এবং কেন এটি অপরিহার্য?
সহজ কথায়, E2EE হলো একটি অদৃশ্য ডিজিটাল তালা। যখন আপনি এই ব্যবস্থায় কাউকে মেসেজ পাঠান, তখন সেই মেসেজটি আপনার ফোন থেকে একটি তালাবদ্ধ অবস্থায় বের হয়। সেই তালার চাবি থাকে শুধু আপনার কাছে এবং আপনি যাকে মেসেজটি পাঠিয়েছেন, তার কাছে। মাঝপথে ফেসবুক বা মেসেঞ্জারের সার্ভার, ইন্টারনেট প্রোভাইডার এমনকি কোনো শক্তিশালী হ্যাকারও সেই মেসেজটি পড়তে পারে না। এটি আপনার কথোপকথনের সর্বোচ্চ গোপনীয়তা নিশ্চিত করে।
সাধারণ মেসেঞ্জার চ্যাটগুলো ফেসবুকের সার্ভারে সুরক্ষিত থাকে, কিন্তু এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড চ্যাট তার চেয়েও অনেক বেশি নিরাপদ। এটি শুধু মেসেঞ্জার হ্যাকিং থেকেই নয়, বরং আপনার ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের যেকোনো প্রচেষ্টা থেকে আপনাকে রক্ষা করে। এটিই হলো আধুনিক মেসেজিং অ্যাপের গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড।
কীভাবে ব্যবহার করবেন? (গোপন চ্যাট ও অন্যান্য উপায়)
- গোপন কথোপকথন (Secret Conversation) শুরু করুন: মেসেঞ্জারে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির সাথে সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় কথা বলার জন্য আপনি একটি "Secret Conversation" শুরু করতে পারেন। এর জন্য:
- যেকোনো চ্যাট ওপেন করে উপরের দিকে থাকা ব্যক্তির নামে ট্যাপ করুন।
- নিচের দিকে স্ক্রল করে "Go to Secret Conversation" অপশনটি বেছে নিন।
- এই চ্যাটে পাঠানো সব মেসেজ এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড থাকবে।
- ডিসঅ্যাপিয়ারিং মেসেজ (Disappearing Messages): এই এনক্রিপ্টেড চ্যাটে আপনি "Disappearing Messages" ফিচারটিও ব্যবহার করতে পারেন। এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময় পর মেসেজগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যাবে, যা আপনার প্রাইভেসিকে আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দেবে।
- ভয়েস ও ভিডিও কল: আনন্দের সংবাদ হলো, মেসেঞ্জারের সকল ভয়েস এবং ভিডিও কল ডিফল্টভাবেই এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড থাকে।
সেটিং ২: লগইন অ্যালার্ট (Login Alerts) - আপনার অ্যাকাউন্টের সতর্ক প্রহরী
যদি আপনার বাড়ির দরজায় কোনো অপরিচিত ব্যক্তি তালা খোলার চেষ্টা করে, আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন সাথে সাথে একটি সতর্কবার্তা পেতে। লগইন অ্যালার্ট ফিচারটি আপনার ফেসবুক ও মেসেঞ্জার অ্যাকাউন্টের জন্য ঠিক সেই কাজটিই করে।
লগইন অ্যালার্ট কেন একটি জীবন রক্ষাকারী ফিচার?
এই ফিচারটি চালু থাকলে, যখনই কোনো নতুন বা অপরিচিত কম্পিউটার, মোবাইল বা ব্রাউজার থেকে আপনার অ্যাকাউন্টে লগইন করা হবে, ফেসবুক তাৎক্ষণিকভাবে আপনার ইমেইলে এবং নোটিফিকেশনে একটি সতর্কবার্তা পাঠিয়ে দেবে। সেই সতর্কবার্তায় লগইনের লোকেশন এবং ডিভাইসের নামও উল্লেখ থাকে। যদি সেই লগইনটি আপনি না করে থাকেন, তবে আপনি সাথে সাথেই বুঝতে পারবেন যে কেউ আপনার পাসওয়ার্ড জেনে গেছে এবং আপনার অ্যাকাউন্টে প্রবেশের চেষ্টা করছে। এর ফলে, আপনি দ্রুত পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে বা সেই সেশনটি লগ আউট করে দিয়ে একটি বড় ধরনের মেসেঞ্জার হ্যাকিং প্রচেষ্টা রুখে দিতে পারবেন।
কীভাবে চালু করবেন? (ধাপে ধাপে নির্দেশিকা)
মেসেঞ্জারের নিরাপত্তা সেটিংস ফেসবুকের "Accounts Center" থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাই এই অপশনটি ফেসবুক অ্যাপ থেকে চালু করতে হবে:
- আপনার ফেসবুক অ্যাপ ওপেন করে মেনু (☰) অপশনে যান।
- "Settings & Privacy" -> "Settings"-এ যান।
- "Accounts Center"-এ ট্যাপ করে "Password and security" অপশনটি বেছে নিন।
- "Login alerts"-এ ক্লিক করুন এবং আপনার অ্যাকাউন্টটি সিলেক্ট করুন।
- এখানে "In-app notifications" এবং "Email"—দুটি অপশনই চালু (On) করে দিন।
সেটিং ৩: অ্যাপ লক (App Lock) - আপনার ফোনের ভেতরের নিরাপত্তা
আপনার ফোনের স্ক্রিন লক নিঃসন্দেহে প্রথম স্তরের সুরক্ষা। কিন্তু ফোনটি যদি আনলক অবস্থায় অন্য কারো হাতে পড়ে? আপনার বন্ধু বা পরিবারের কেউ হয়তো আপনার ফোনটি ব্যবহার করার জন্য নিলো, কিন্তু আপনি চান না তারা আপনার ব্যক্তিগত মেসেজগুলো দেখুক। এখানেই কাজে আসে অ্যাপ লক।
অ্যাপ লক কেন ব্যবহার করা উচিত?
অ্যাপ লক ফিচারটি আপনার মেসেঞ্জার অ্যাপের জন্য একটি অতিরিক্ত নিরাপত্তা স্তর যোগ করে। এটি চালু থাকলে, মেসেঞ্জার অ্যাপটি খোলার জন্য প্রতিবার আপনার আঙুলের ছাপ (Fingerprint), ফেস আইডি (Face ID) বা ফোনের পাসকোডের প্রয়োজন হবে। এর ফলে, আপনার ফোন আনলক থাকলেও আপনার অনুমতি ছাড়া কেউ আপনার ব্যক্তিগত চ্যাটবক্সে ঢুকতে পারবে না। এটি শারীরিক বা সরাসরি ডিজিটাল নিরাপত্তা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একটি চমৎকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
কীভাবে চালু করবেন? (ধাপে ধাপে নির্দেশিকা)
- আপনার মেসেঞ্জার অ্যাপটি ওপেন করুন এবং উপরের বাম দিকের মেনু (☰) আইকনে ট্যাপ করুন।
- এরপর ডানদিকে থাকা সেটিংস (⚙️) আইকনে ক্লিক করুন।
- "Privacy & safety" অপশনে যান।
- "App lock" অপশনটি খুঁজে বের করে সেটিতে ট্যাপ করুন।
- "Unlock with biometrics" বা এই ধরনের অপশনটি চালু করে দিন।
সেটিং ৪: মেসেজ রিকোয়েস্ট নিয়ন্ত্রণ (Control Message Requests) - অচেনা আগন্তুকদের দরজায় থামিয়ে দিন
ডিফল্টভাবে, ফেসবুকে আপনার বন্ধু নয় এমন যে কেউ আপনাকে মেসেজ পাঠাতে পারে, যা আপনার "Message Requests" ফোল্ডারে জমা হয়। এই ফোল্ডারটিই হলো বেশিরভাগ মেসেঞ্জার স্ক্যাম, ফিশিং লিঙ্ক এবং অনলাইন হয়রানির প্রবেশদ্বার।
মেসেজ রিকোয়েস্ট ফিল্টার করা কেন জরুরি?
অপরিচিত ব্যক্তিদের মেসেজ সরাসরি ইনবক্সে আসা বন্ধ করে আপনি নিজেকে অসংখ্য বিপদ থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারেন। কারা আপনাকে সরাসরি মেসেজ করতে পারবে এবং কাদের মেসেজ রিকোয়েস্ট ফোল্ডারে যাবে, তা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আপনি স্প্যাম এবং প্রতারণামূলক মেসেজের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনতে পারেন।
কীভাবে সেটিংস পরিবর্তন করবেন?
- মেসেঞ্জারের Settings -> "Privacy & safety"-তে যান।
- "Message delivery" অপশনে ট্যাপ করুন।
- এখানে আপনি বিভিন্ন ক্যাটাগরি দেখতে পাবেন, যেমন: "People with your phone number", "Friends of friends on Facebook", "Others on Facebook" ইত্যাদি।
- প্রতিটি ক্যাটাগরিতে প্রবেশ করে আপনি ঠিক করতে পারেন যে তাদের মেসেজগুলো সরাসরি আপনার চ্যাট লিস্টে আসবে, রিকোয়েস্ট ফোল্ডারে যাবে, নাকি আপনি তাদের রিকোয়েস্ট গ্রহণই করবেন না ("Don't receive requests")। আমরা "Others on Facebook" অপশনটি "Don't receive requests" করে রাখার পরামর্শ দিচ্ছি।
সেটিং ৫: অ্যাক্টিভ স্ট্যাটাস নিয়ন্ত্রণ (Control Your Active Status) - অনলাইনে থেকেও থাকুন আড়ালে
এটি সরাসরি হ্যাকিং প্রতিরোধের টুল না হলেও, আপনার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং মানসিক শান্তির জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি একটি ফিচার।
অ্যাক্টিভ স্ট্যাটাস বন্ধ করার সুবিধা কী?
আপনি কখন অনলাইনে আছেন, তা সবাই দেখতে পেলে অনেক সময় বিড়ম্বনা তৈরি হয়। এটি একদিকে যেমন আপনার ওপর দ্রুত মেসেজের উত্তর দেওয়ার জন্য একটি সামাজিক চাপ তৈরি করে, তেমনই অন্যদিকে কিছু মানুষ আপনার অনলাইন কার্যকলাপ ট্র্যাক করার সুযোগ পায়। আপনার অ্যাক্টিভ স্ট্যাটাস বন্ধ করে রাখলে, আপনি আপনারสะดวกমতো সময়ে মেসেজ দেখতে এবং উত্তর দিতে পারবেন, যা আপনাকে দেবে মানসিক শান্তি এবং বাড়তি গোপনীয়তা।
কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করবেন?
- মেসেঞ্জারের Settings -> "Privacy & safety"-তে যান।
- "Active status" অপশনে ক্লিক করুন।
- "Show when you're active" এর পাশের টগল বাটনটি অফ করে দিন। মনে রাখবেন, এটি বন্ধ করলে আপনিও অন্য কেউ অনলাইনে আছে কি না, তা দেখতে পাবেন না।
বোনাস: মেসেঞ্জারে প্রতারণার ফাঁদ চেনার উপায়
- হঠাৎ করে কোনো বন্ধুর প্রোফাইল থেকে টাকা চেয়ে মেসেজ এলে, তাকে ফোন করে নিশ্চিত হন।
- লটারি জেতা বা অবিশ্বাস্য অফারের লিঙ্কে ক্লিক করবেন না।
- দুর্বল বানান ও ব্যাকরণে লেখা মেসেজগুলো এড়িয়ে চলুন।
শেষ কথা
আপনার ডিজিটাল জীবনের নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতেই। উপরে আলোচিত ৫টি সেটিংস আপনার মেসেঞ্জার নিরাপত্তাকে একটি মজবুত ভিত্তি দেবে। এই কাজগুলো করতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় লাগবে না, কিন্তু এর সুফল আপনি পাবেন দীর্ঘদিন। আজই আপনার মেসেঞ্জারের এই সেটিংসগুলো পরীক্ষা করুন এবং আপনার ব্যক্তিগত কথোপকথনকে রাখুন সম্পূর্ণ সুরক্ষিত।
0 মন্তব্যসমূহ