সন্তানের ছবি অনলাইনে শেয়ার করলে কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়?
আপনার সন্তানের প্রথম স্কুল ড্রেস পরা ছবিটি হয়তো আপনার ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার। তার প্রথম হাঁটার ভিডিওটি হয়তো আপনার ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে শোভা পাচ্ছে। সন্তানের মুখের এক চিলতে হাসি, তার নিষ্পাপ চাহনি বা যেকোনো আনন্দময় মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করে বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজনের সাথে শেয়ার করার যে অনুভূতি, তার কোনো তুলনা হয় না। নতুন বাবা-মা থেকে শুরু করে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের অভিভাবকের জন্যই এটি ভালোবাসা প্রকাশের এক স্বাভাবিক এবং শক্তিশালী মাধ্যম।
কিন্তু এই নিষ্পাপ আবেগ এবং ভালোবাসার প্রকাশের আড়ালেই কি আমরা নিজের অজান্তেই আমাদের সন্তানদের এক বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছি? আধুনিক ডিজিটাল প্যারেন্টিং-এর জগতে একটি নতুন শব্দ খুব জনপ্রিয় হয়েছে—Sharenting (শেয়ারেন্টিং), যা Share (শেয়ার) এবং Parenting (অভিভাবকত্ব) শব্দ দুটি মিলে তৈরি। এর অর্থ হলো, মা-বাবার দ্বারা সন্তানের ছবি বা জীবনের নানা মুহূর্ত নিয়মিতভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার অভ্যাস।
এই আর্টিকেলটির উদ্দেশ্য আপনাকে ভয় দেখানো বা সন্তানের ছবি শেয়ার করা থেকে বিরত করা নয়। এর উদ্দেশ্য হলো, এই "Sharenting"-এর পেছনের সেই সব অদৃশ্য ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে আপনাকে সচেতন করা, যা আপনার সন্তানের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। চলুন, বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক, সন্তানের ছবি অনলাইনে শেয়ার করলে ঠিক কী কী বিপদকে আমরা আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
যে ৫টি মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছেন আপনি
আপনি যখন আপনার সন্তানের একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন, তখন সেটি আর শুধু একটি ছবি থাকে না; এটি পরিণত হয় একটি ডেটা পয়েন্টে, যা বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত বা অপব্যবহৃত হতে পারে।
১. ডিজিটাল কিডন্যাপিং এবং পরিচয় চুরি (Digital Kidnapping & Identity Theft)
এটি শেয়ারেন্টিং-এর সবচেয়ে ভীতিকর এবং সরাসরি ঝুঁকিগুলোর একটি।
-
ডিজিটাল কিডন্যাপিং কী? সহজ কথায়, প্রতারক বা মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরা আপনার সন্তানের ছবি আপনার প্রোফাইল থেকে ডাউনলোড করে এবং তাদের নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে আপলোড করে নিজেদের সন্তান হিসেবে দাবি করে। তারা আপনার সন্তানের ছবিতে নতুন নাম দিয়ে, কাল্পনিক গল্প তৈরি করে পোস্ট করতে থাকে। ভাবুন তো, অন্য কেউ আপনার সন্তানের ছবি ব্যবহার করে একটি মিথ্যা জীবনযাপন করছে! এটি মা-বাবার জন্য শুধু মানসিক যন্ত্রণারই নয়, বরং সন্তানের পরিচয় নিয়েও এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করে। এই ধরনের সাইবার অপরাধ দিন দিন বাড়ছে।
-
পরিচয় চুরির ভবিষ্যৎ ঝুঁকি: আপনি যখন সন্তানের ছবিসহ তার পুরো নাম, জন্মদিন এবং অন্যান্য তথ্য শেয়ার করেন, তখন আপনি আসলে তার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট তৈরি করে দিচ্ছেন। আজকের দিনে এই তথ্যগুলো নিরীহ মনে হলেও, ১৫-২০ বছর পর এই ডেটাগুলোই একজন অপরাধীর জন্য আপনার সন্তানের নামে ব্যাংক লোন নেওয়া, ক্রেডিট কার্ড তৈরি করা বা অন্য কোনো অপরাধমূলক কাজ করার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। আপনি ভালোবাসার বশে যে তথ্য দিচ্ছেন, তা আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ পরিচয়ের জন্য একটি বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
২. সন্তানের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন (Violation of the Child's Personal Privacy)
আজকের শিশু আগামী দিনের একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, যার নিজস্ব প্রাইভেসি বা গোপনীয়তার অধিকার রয়েছে।
-
আজকের আদর, আগামী দিনের লজ্জা: আপনি হয়তো আপনার সন্তানের গোসলের সময়ের কোনো মজার ছবি বা তার রাগ করে কান্না করার কোনো ভিডিও খুব আদরের সাথে শেয়ার করলেন। আপনার বন্ধুদের কাছে এটি একটি মিষ্টি মুহূর্ত হতে পারে, কিন্তু ১০-১২ বছর পর আপনার সন্তান যখন কৈশোরে পা দেবে, তখন এই ছবি বা ভিডিওটিই তার জন্য লজ্জা, অপমান বা স্কুল-কলেজে উপহাসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তার বন্ধুরা এই ছবি দেখিয়ে তাকে উত্যক্ত করতে পারে। আমরা অভিভাবক হিসেবে প্রায়ই ভুলে যাই যে, ইন্টারনেটে শেয়ার করা কোনো কিছুই পুরোপুরি মুছে ফেলা যায় না।
-
সম্মতি ছাড়া ডিজিটাল পরিচয় তৈরি: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, আপনি আপনার সন্তানের সম্মতি ছাড়াই তার একটি অনলাইন পরিচয় তৈরি করে দিচ্ছেন। তার জীবনের কোন মুহূর্তটি ব্যক্তিগত থাকবে এবং কোনটি öffentlich হবে, সেই সিদ্ধান্তটি তার পক্ষ থেকে আপনিই নিয়ে নিচ্ছেন। একজন ব্যক্তি হিসেবে তার নিজের ডিজিটাল পরিচয় নিয়ন্ত্রণ করার এই অধিকারকে সম্মান করা অত্যন্ত জরুরি।
৩. সাইবার বুলিং এবং উপহাসের শিকার (Victim of Cyberbullying and Mockery)
শিশুরা অনেক সময় খুবই নির্দয় হতে পারে এবং ইন্টারনেট এই নির্দয়তাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
- কীভাবে ছবি বুলিংয়ের হাতিয়ার হয়? আপনার শেয়ার করা একটি সাধারণ ছবিও সাইবার বুলিং-এর হাতিয়ার হতে পারে। সন্তানের একটি বিশেষ পোশাক, তার কোনো শারীরিক বৈশিষ্ট্য বা একটি মজার মুখভঙ্গির ছবিকে বিকৃত করে মেমে (Meme) তৈরি করা হতে পারে। এই মেমেগুলো বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে পড়ে এবং আপনার সন্তান তার বন্ধুদের কাছে হাসির পাত্রে পরিণত হতে পারে। এই ধরনের উপহাস তার আত্মবিশ্বাসের ওপর মারাত্মকভাবে আঘাত হানে।
৪. অনলাইন প্রিডেটর বা এর মনোযোগ আকর্ষণ
এটি শেয়ারেন্টিং-এর সবচেয়ে অন্ধকার এবং বিপজ্জনক দিক।
- অদৃশ্য তথ্য পাচার: আপনি যখন একটি ছবি পোস্ট করেন, তখন শুধু ছবিটিই শেয়ার হয় না, এর সাথে অনেক অদৃশ্য তথ্যও শেয়ার হয়ে যেতে পারে। ছবির পেছনে থাকা আপনার বাড়ির আসবাবপত্র, সন্তানের স্কুলের ইউনিফর্ম, বা ছবির জিওট্যাগ (Geotag) থেকে আপনার লোকেশন—এই সব তথ্য একজন অপরাধীর জন্য আপনার সন্তানের দৈনন্দিন রুটিন এবং অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
- বিপজ্জনক উদ্দেশ্য: দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কিছু শিশু নির্যাতনকারী বা পেডোফাইল চক্র অনলাইনে শিশুদের ছবি সংগ্রহ করে এবং সেগুলোকে তাদের অবৈধ এবং বিকৃত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। তারা এই ছবিগুলো নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে বা ডার্ক ওয়েবে বিক্রি পর্যন্ত করে। আপনার শেয়ার করা একটি নিষ্পাপ ছবিও এই ধরনের নেটওয়ার্কের হাতে চলে যেতে পারে।
৫. আপনার নিজের নিরাপত্তার ঝুঁকি (Risks to Your Own Security)
সন্তানের তথ্য শেয়ার করতে গিয়ে আপনি নিজের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলছেন।
- সিকিউরিটি প্রশ্নের উত্তর: অনেক সময় আমরা আমাদের অনলাইন অ্যাকাউন্টের (যেমন: ব্যাংক অ্যাকাউন্ট) সিকিউরিটি প্রশ্ন হিসেবে সন্তানের নাম, জন্মদিন বা পোষা প্রাণীর নাম ব্যবহার করি। আপনি যখন ফেসবুকে পোস্ট করেন, "আমার ছেলে আবিরের পঞ্চম জন্মদিনে সবাইকে স্বাগতম," তখন আপনি আসলে আপনার একটি সম্ভাব্য পাসওয়ার্ড রিসেট প্রশ্নের উত্তর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন।
- চুরির ঝুঁকি: আপনি যখন পরিবারের সাথে ছুটি কাটানোর ছবি রিয়েল-টাইমে পোস্ট করেন, তখন আপনি আসলে পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে আপনার বাড়ি এই মুহূর্তে খালি। এটি চোর বা ডাকাতদের জন্য একটি খোলা আমন্ত্রণ হতে পারে।
তাহলে কি ছবি শেয়ার করা বন্ধ করে দেবেন? না! বরং জানুন নিরাপদ উপায়
উপরের ঝুঁকিগুলো জানার পর আতঙ্কিত হয়ে ছবি শেয়ার করা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। সমাধান হলো সচেতনভাবে এবং নিরাপদ উপায়ে শেয়ার করা। নিচে কিছু কৌশল দেওয়া হলো:
- প্রাইভেসি সেটিংস কঠোর করুন: আপনার ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলের প্রাইভেসি "Public" থেকে পরিবর্তন করে "Friends" বা "Only Me" করুন। ছবি শেয়ার করার সময় নির্দিষ্ট বন্ধুদের তালিকা ("Close Friends" বা কাস্টম লিস্ট) তৈরি করে শুধুমাত্র তাদের সাথেই শেয়ার করুন।
- গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুছে দিন: ছবি পোস্ট করার আগে ছবির জিওট্যাগ বা লোকেশন তথ্য বন্ধ করুন। এমন ছবি শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন যেখানে আপনার সন্তানের স্কুলের নাম, বাড়ির নম্বর বা অন্য কোনো শনাক্তকারী চিহ্ন ভাবে বোঝা যায়।
- সন্তানের সম্মতি নিন: আপনার সন্তান যদি কথা বলার মতো বড় হয়, তবে তার ছবি পোস্ট করার আগে অবশ্যই তার অনুমতি নিন। তাকে জিজ্ঞেস করুন, "আমি কি তোমার এই ছবিটি ফেসবুকে বন্ধুদের দেখাতে পারি?"। এটি তাকে নিজের পরিচয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং সম্মতির গুরুত্ব শেখাবে।
- মুখ বা শনাক্তকারী চিহ্ন আড়াল করুন: আপনি চাইলে সন্তানের মুখ একটি স্টিকার দিয়ে ঢেকে দিতে পারেন অথবা এমন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলতে পারেন যেখানে তার মুখ স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না (যেমন: পেছন থেকে তোলা ছবি)।
- সংবেদনশীল ছবি এড়িয়ে চলুন: সন্তানের গোসলের ছবি, ডায়াপার পরা ছবি, কান্নাকাটি করার মুহূর্ত বা যেকোনো বিব্রতকর অবস্থার ছবি কখনোই অনলাইনে শেয়ার করবেন না।
শেষ কথা
অভিভাবক হিসেবে আমাদের ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ডিজিটাল যুগে, ভালোবাসার সাথে একটুখানি ডিজিটাল নিরাপত্তার জ্ঞান এবং সচেতনতা মেশানো অপরিহার্য। প্রতিটি পোস্ট করার আগে এক মুহূর্ত ভাবুন—এই ছবিটি বা তথ্যটি কি আমার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য কোনো ঝুঁকি তৈরি করতে পারে?
আপনার প্রতিটি শেয়ার আপনার সন্তানের ডিজিটাল জীবনের একটি স্থায়ী অংশ হয়ে যাচ্ছে। আসুন, আমরা আমাদের ভালোবাসা এবং আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে একটুখানি সতর্কতা অবলম্বন করি এবং আমাদের সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ ডিজিটাল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করি।
0 মন্তব্যসমূহ