আপনি কি জানেন? ফেসবুক প্রতিদিন আপনার কোন কোন তথ্য সংগ্রহ করছে!

 আপনি কি জানেন? ফেসবুক প্রতিদিন আপনার কোন কোন তথ্য সংগ্রহ করছে!

"ফেসবুক অ্যাপে ডেটা স্ট্রিম ভিজ্যুয়ালাইজেশন সহ ফোনের ছবি।"
আপনি যখন স্ক্রল করছেন, ফেসবুক তখন আপনার তথ্য সংগ্রহ করছে!

আপনি হয়তো ঘুম থেকে উঠেই একবার আপনার ফেসবুক নিউজফিডটি দেখে নিয়েছেন। কোনো চায়ের দোকানে বসে বন্ধুদের সাথে তোলা ছবি আপলোড করেছেন, অথবা প্রিয় কোনো ব্র্যান্ডের পেজে লাইক দিয়েছেন। ফেসবুক আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে—এটি আমাদের সামাজিক যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু, খবরের উৎস এবং বিনোদনের মাধ্যম।

কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, এই যে বিশাল একটি প্ল্যাটফর্ম আপনি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্যবহার করছেন, এর পেছনের আসল ব্যবসায়িক মডেলটা কী? প্রযুক্তি বিশ্বে একটি জনপ্রিয় কথা প্রচলিত আছে: "If you're not paying for the product, you are the product." অর্থাৎ, "আপনি যদি কোনো পণ্যের জন্য অর্থ প্রদান না করেন, তবে আপনি নিজেই সেই পণ্য।"

ফেসবুকের ক্ষেত্রে এই কথাটি शतভাগ সত্যি। আপনি টাকা দিয়ে ফেসবুক ব্যবহার করেন না, বরং আপনার ব্যক্তিগত তথ্য বা ডেটা দিয়েই এর মূল্য পরিশোধ করেন। এই আর্টিকেলে আমরা পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দেখব, ফেসবুক ডেটা সংগ্রহ কীভাবে কাজ করে এবং এই সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট আপনার সম্পর্কে ঠিক কী কী জানে, যা হয়তো আপনি নিজেও জানেন না।

ফেসবুক কেন আপনার তথ্য সংগ্রহ করে?

এর পেছনের মূল এবং একমাত্র কারণ হলো বিজ্ঞাপন (Advertising)। ফেসবুক dünyanın অন্যতম বড় একটি বিজ্ঞাপন সংস্থা। আপনার সংগ্রহ করা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ফেসবুক আপনার একটি ডিজিটাল প্রোফাইল তৈরি করে। এই প্রোফাইল থেকে তারা আপনার বয়স, লিঙ্গ, অবস্থান, আগ্রহ, শখ, কেনার অভ্যাস এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ পর্যন্ত অনুমান করতে পারে।

এই বিস্তারিত প্রোফাইলের কারণেই বিভিন্ন কোম্পানি (যেমন: পোশাকের ব্র্যান্ড, রেস্টুরেন্ট বা ই-কমার্স সাইট) ফেসবুকে অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে। যেমন, কোনো কসমেটিক্স ব্র্যান্ড চাইলে শুধু ঢাকার ১৮-২৫ বছর বয়সী নারীদেরকেই তাদের বিজ্ঞাপন দেখাতে পারে, যারা অনলাইনে কেনাকাটা করতে ভালোবাসেন। এই টার্গেটেড বিজ্ঞাপনের জন্যই কোম্পানিগুলো ফেসবুককে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করে, আর এটাই ফেসবুকের আয়ের মূল উৎস।

ফেসবুক আপনার কোন কোন তথ্য সংগ্রহ করছে?

ফেসবুকের ডেটা সংগ্রহের পরিধি বিশাল। এটিকে আমরা মূলত তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করতে পারি।

ক্যাটাগরি ১: যে তথ্যগুলো আপনি নিজে সরাসরি দেন (Information You Provide Directly)

এই তথ্যগুলো হলো যা আপনি জেনে-বুঝে নিজের প্রোফাইল তৈরি করার সময় বা ফেসবুক ব্যবহার করার সময় দিয়ে থাকেন।

  • প্রোফাইলের তথ্য: আপনার নাম, প্রোফাইল পিকচার, কভার ফটো, বয়স, জন্মদিন, লিঙ্গ, ইমেইল, ফোন নম্বর।
  • ব্যক্তিগত বিবরণ: আপনি কোথায় পড়াশোনা করেছেন, কোথায় কাজ করেন, আপনার বর্তমান এবং অতীতের বাসস্থান, আপনার সম্পর্কের স্ট্যাটাস (Single, Married, etc.)।
  • আপনার তৈরি কন্টেন্ট: আপনি যে স্ট্যাটাস আপডেট দেন, যে ছবি বা ভিডিও আপলোড করেন, যে স্টোরি শেয়ার করেন—সবকিছুই ফেসবুক বিশ্লেষণ করে। এমনকি, মেসেঞ্জারে পাঠানো মেসেজও (যদি এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড না হয়) তাদের ডেটা সংগ্রহের আওতায় থাকে।
  • আপনার নেটওয়ার্ক: আপনি কাদের সাথে বন্ধু হচ্ছেন, কোন গ্রুপে যোগ দিচ্ছেন, কোন পেজ বা ইভেন্টে লাইক দিচ্ছেন বা অংশ নিচ্ছেন, সেই তালিকাও ফেসবুক সংরক্ষণ করে।

ক্যাটাগরি ২: আপনার কার্যকলাপ ও ব্যবহারের ধরণ (Your Activity and Usage Patterns)

আপনি সরাসরি কোনো তথ্য না দিলেও, ফেসবুক ব্যবহারের প্রতিটি মুহূর্তে আপনার কার্যকলাপ ট্র্যাক করা হয়। এই ফেসবুক কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

  • ব্যবহারের ধরণ: আপনি কোন পোস্টে লাইক দিচ্ছেন, কোন ধরনের ভিডিও বেশিক্ষণ দেখছেন, কোন লিঙ্কে ক্লিক করছেন, কার পোস্টে বেশি কমেন্ট করছেন—এই সবকিছুই আপনার আগ্রহ বোঝার জন্য ট্র্যাক করা হয়। আপনি কোনো একটি পোস্টে কতক্ষণ সময় ব্যয় করছেন, সেটাও তাদের ডেটার অংশ।
  • ডিভাইস সংক্রান্ত তথ্য: আপনি কোন মডেলের মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করছেন, তার অপারেটিং সিস্টেম (Android/iOS/Windows), ব্রাউজারের ধরণ, এমনকি আপনার ফোনের ব্যাটারির লেভেল এবং নেটওয়ার্ক সিগন্যালের শক্তি পর্যন্ত ফেসবুক সংগ্রহ করতে পারে।
  • লোকেশন বা অবস্থান: আপনি যদি আপনার ফোনের জিপিএস (GPS) চালু রাখেন, তবে ফেসবুক আপনার সুনির্দিষ্ট অবস্থান ট্র্যাক করতে পারে। আপনি কোথায় কোথায় যাচ্ছেন, কোন রেস্টুরেন্টে চেক-ইন করছেন, বা কোন দোকানে যাচ্ছেন—এই সব তথ্য ব্যবহার করে আপনাকে সেই এলাকার বিজ্ঞাপন দেখানো হয়।

ক্যাটাগরি ৩: সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় - ফেসবুকের বাইরের কার্যকলাপ (Off-Facebook Activity)

এটিই ফেসবুক প্রাইভেসির সবচেয়ে বিতর্কিত এবং ভীতিকর দিক। আপনি যখন ফেসবুক ব্যবহার করছেন না, তখনও ফেসবুক আপনার ওপর নজর রাখছে!

এটা কীভাবে সম্ভব? ইন্টারনেটের লক্ষ লক্ষ ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ তাদের পরিষেবা উন্নত করতে এবং বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ফেসবুকের বিজনেস টুলস (যেমন: Facebook Pixel, SDK, Login with Facebook) ব্যবহার করে। যখনই আপনি এই ধরনের কোনো ওয়েবসাইট বা অ্যাপ ব্যবহার করেন, তারা আপনার কার্যকলাপের তথ্য ফেসবুকের সাথে শেয়ার করে।

  • বাস্তব উদাহরণ:
    • আপনি হয়তো কোনো ই-কমার্স সাইটে (যেমন: দারাজ) একটি জুতো দেখলেন, কিন্তু কিনলেন না। কিছুক্ষণ পর ফেসবুকে ঢুকলেই দেখবেন, ঠিক সেই জুতোটিরই বিজ্ঞাপন আপনার নিউজফিডে চলে এসেছে।
    • আপনি কোনো নিউজ পোর্টালে খেলাধুলা বা রাজনীতি নিয়ে একটি আর্টিকেল পড়লেন। ফেসবুক জেনে গেল যে, আপনি এই বিষয়গুলোতে আগ্রহী এবং আপনাকে সেই অনুযায়ী কন্টেন্ট বা বিজ্ঞাপন দেখাবে।
    • আপনি যখন অন্য কোনো অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে "Login with Facebook" বাটন ব্যবহার করে লগইন করেন, তখন আপনি সেই অ্যাপকে আপনার ফেসবুকের তথ্য ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে দেন।

এই Off-Facebook Activity-এর মাধ্যমে ফেসবুক শুধু তার নিজের প্ল্যাটফর্মেই নয়, বরং সমগ্র ইন্টারনেট জুড়ে আপনার কার্যকলাপের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তৈরি করে, যা তাদের বিজ্ঞাপন ব্যবসাকে আরও শক্তিশালী করে।

আপনি কী করতে পারেন? (আপনার করণীয়)

সম্পূর্ণরূপে ডেটা সংগ্রহ বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব, কিন্তু আপনি অবশ্যই এর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেন। আপনার অনলাইন গোপনীয়তা বাড়াতে নিচের পদক্ষেপগুলো নিন:

  1. প্রাইভেসি চেকআপ (Privacy Checkup) ব্যবহার করুন: ফেসবুকের সেটিংসে থাকা এই টুলটি আপনাকে ধাপে ধাপে আপনার প্রাইভেসি সেটিংসগুলো রিভিউ এবং পরিবর্তন করতে সাহায্য করবে।
  2. ‘Off-Facebook Activity’ রিভিউ করুন:
    • Settings & Privacy -> Settings -> Your Facebook Information -> Off-Facebook Activity-তে যান।
    • এখানে আপনি দেখতে পাবেন কোন কোন অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট আপনার তথ্য ফেসবুককে পাঠিয়েছে। আপনি চাইলে এই ইতিহাস মুছে ফেলতে পারেন (Clear History) এবং ভবিষ্যৎ কার্যকলাপ সংগ্রহ বন্ধও (Disconnect Future Activity) করতে পারেন।
  3. ‘Download Your Information’ টুল: এই টুলটি ব্যবহার করে আপনি দেখতে পারবেন, ফেসবুক আপনার সম্পর্কে ঠিক কী কী তথ্য সংরক্ষণ করেছে।
  4. অ্যাপ পারমিশন নিয়ন্ত্রণ করুন: Settings -> Apps and Websites-এ গিয়ে দেখুন, কোন কোন অ্যাপ আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে লগইন করা আছে। অপ্রয়োজনীয় অ্যাপগুলোর অ্যাক্সেস রিমুভ করে দিন।

শেষ কথা

ফেসবুক বা যেকোনো "ফ্রি" ডিজিটাল সার্ভিস ব্যবহার করার অর্থই হলো, সুবিধার বিনিময়ে নিজের তথ্যের কিছু অংশ প্রদান করা। আমাদের লক্ষ্য ফেসবুক ব্যবহার ছেড়ে দেওয়া নয়, বরং একজন সচেতন ও知情 ব্যবহারকারী হওয়া। আপনার তথ্য আপনারই সম্পদ। এটি কার সাথে, কীভাবে শেয়ার করছেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আপনার হাতেই রয়েছে। উপরের ফেসবুক সেটিংস গুলো নিয়মিত রিভিউ করুন এবং আপনার ডিজিটাল জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখুন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ